ছবি: বাংলা
রাকিব হাসান:
রাজধানী ঢাকা থেকে যে কোন যানবাহনে মাত্র ১৪/১৫ কিলোমিটার পথ পেরুলেই নদী পাড়ের জেলা নারায়ণগঞ্জ। শীতলক্ষ্যার কোল ঘেষে রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভা। দেশের একমাত্র জামদানি পল্লীটি রয়েছে এখানেই।
গ্রামের রাস্তাটা বেশ আঁকাবাকা নদীর সঙ্গে খেই মিলিয়ে চলেছে। রাস্তার দু’ধারেই অসংখ্য তাঁত চোখে পড়বে। গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই কোননা কোনোভাবে জামদানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক সময় এটি ছিল অজপাড়াগাঁ। জামদানী শিল্প এ গ্রামের চেহারা বদলে দিয়েছে।
এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এক সময়ের বিশ্বখ্যাত মসলিন শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বৃটিশ শাসকরা এ শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার পর গ্রামের মানুষ আবার ফিরে যান কৃষি পেশায়। বৃটিশদের পতনের পর মসলিন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বংশধররা আবারো মসলিন তৈরির কাজে হাত দেন। কিন্তু তারা সেই মসলিনের জৌলস ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। কিন্তু আদলেই তৈরি করেন নতুন এক শাড়ি। যা আজকের জামদানি। এ জামদানিও আজ জগত বিখ্যাত। লাভজনক হওয়ার কারণে গ্রামের অনেকেই এগিয়ে আসেন জামদানি তাঁত প্রতিষ্ঠায়।
পার্শ্ববর্তী রূপসী, কাকিনা, মৈকুলী, বরাব গ্রামের অনেক পরিবার এ কাজে এগিয়ে আসেন। তারাও গড়ে তোলেন তাঁত কারখানা। গ্রামের ঘরে ঘরে গড়ে উঠে তাঁত কারখানা। জামদানি তাঁত কারখানা প্রতিষ্ঠা করে মালিকদের অনেকেরই বদলে গেছে জীবনযাত্রা। এ শিল্পই তাদের জীবনে বয়ে এনেছে সুখের দিন। জামদানি তৈরীতে বাংলাদেশই একমাত্র ও একক স্বত্তাধীকারী এবং তা একমাত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে উৎপাদন করা হয়।
এখানে বংশ পরম্পরায় এই ঐতিহ্যববাহী পোশাক শিল্পের শিল্পী তৈরি হয় পরিবারের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায়। জামদানী তৈরীতে কেউ সরাসরি কাপড় উৎপাদন করেন, কেউ তাঁতী; কেউ সুতা বিক্রেতা; আবার কেউ বিদেশে কাপড় রপ্তানির কাজে জড়িত। প্রতি পরিবারেই গড়পরতা ২/১টি তাঁত রয়েছে। তাঁতিরা সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। জামদানি কারখানায় প্রবেশ করতেই দেখা গেল মনের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে তারা বুনে চলেছেন বাংলাদেশের র্ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি।
এখানকার জামদানি তাঁতীদের অধিকাংশেরই বয়স ১৩ থেকে ৩০ এর মধ্যে। বয়স্ক তাঁতী নেই তা নয়। তবে কম বয়সী তাঁতীরাই জামদানির কাজের সঙ্গে বেশি জড়িত। এখানকারই একজন তাঁতী জয়নাল। মাত্র ১০ বছর বয়সে জামদানি বুননের কাজ শুরু করেছিলেন। এখন তার বয়স ৩৫ বছর। একে একে কেটে গেছে ২৫টি বছর। জয়নাল প্রায় ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী এ পেশার সঙ্গে যুক্ত। তার জাদুর হাতে কতজনকে উপহার দিয়েছেন নজরকাড়া জামদানি শাড়ি।
জামদানি শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল। অলস কেউ এ শিল্পে টিকে থাকতে পারেন না। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কাজ সারা দিন করার মানসিকতা অনেকের থাকে না। তাই অল্প বয়স্করাই এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের কিছু কিছু এলাকায়ও এ শিল্পের মহিমা ছড়িয়ে আছে। মূলত জামদানি শাড়ির কী দেশ কী বিদেশ কোথাও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
জামদানি পল্লীতে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় জামদানি ব্যবসায়ী শহীদের সঙ্গে। তিনি জানান, জামদানি তৈরীর কাঁচামাল সরবরাহ করা হয় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় বাজার থেকেই। সুতা বা জরি স্থানীয় বাজার থেকে কিনলেও জামদানি শাড়ির অন্যতম উপাদান রেশম আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। আমাদের দেশীয় রেশম গুণে-মানে মানসম্পন্ন কম, তাই জামদানি তৈরীতে রেশম আমদানিতেই ভরসা রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
শহীদ বলেন, এটি তাদের পাঁচ পুরুষের ব্যবসা। প্রায় ২০০ বছর ধরে তিনি এবং তার পূর্বপুরুষরা এই শাড়ি তৈরীর ব্যবসা করে আসছেন। শুরুতে তাদের পূর্বপুরুষরা জগৎবিখ্যাত মসলিন শাড়ি উৎপাদন করলেও এখন কালের পরিবর্তে তিনি জামদানি শাড়ি উৎপাদন করেন। তিনি এবং তার পরিবার জামদানি শাড়ি উৎপাদন করে এখন স্বাবলম্বী।
জামদানি শাড়ি মূলত ২ প্রকার। একটা হলো ‘হাফ সিল্ক’ আরেকটা ‘ফুল কটন’। এই শাড়ির মূল্য ৩ হাজার ৫০০ থেকে শুরু করে ১ লাখ ৩০ হাজার পর্যন্ত বিক্রি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
জামদানি তৈরির হাতে খড়ি শৈশব ও কৈশরের মাঝামাঝি সময় থেকে না শিখলে একজন যথার্থ কারিগর হয়ে উঠতে পারেন না বলে মনে করেন এই শিল্পের কারিগররা। কিন্তু শিশুশ্রম বিরোধী আইনী বিধি বিধানের কারনে জামদানি শিল্পী তৈরি করা ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগররা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। জামদানি শাড়ীর শিল্পে যুক্ত কারিগরদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহন থাকলেও মূল তাঁতীর ভূমিকায় যারা শাড়ী বুনেন এবং নকশা কাটেন তারা সকলেই পুরুষ।
প্রতিটি জামদানি শাড়ী তৈরির পেছনের সকল কাজ কারিগরদের হাত ও পায়ের ব্যবহারে পরিচালিত হয়। কোনধাপেই কোন আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার নেই। একটি শাড়ি তৈরিতে ১ সপ্তাহ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় একজন মূল কারিগর ও তার হেলপার বা সাহায্যকারীর। সময় আর কাজের উপর দাম নির্ভর করে। তবে একজন হেলপার (বাম পাশে বসে যিনি কাজ করেন) সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা এবং সর্বনিন্ম ১২০০ টাকা মজুরি পান। এক্ষেত্রে মূল কারিগর (ডান পাশে বসে যিনি কাজ করেন) সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ ৩৫০০ টাকা এবং সর্বনিন্ম ২০০০ টাকা মজুরি পান।
দেশের চাহিদা পূরণ করে ভারতসহ পাশ্ববর্তী ২/১টি দেশে জামদানি শাড়ি রপ্তানি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের জামদানির সুনাম এখন বিশ্ব জোড়া।
বাংলা/আরএইচ