মিমি হোসেন, ছবি: সংগৃহীত
মিমি হোসেন
(১)
বেড নম্বর ২ এর পেশেন্ট এর হ্যান্ডওভার আগে দেই আপু। ম্যাসিভ হার্ট এটাক উইথ কার্ডিয়াক এরেস্ট। প্রায় টানা ৩০ মিনিট কার্ডিয়াক মেসেজ পাওয়ার পর ব্যাক করেছে। ভাইটালস আর ইন অ্যা ভেরি ব্যাড শেপ আপু। ভোর অবধি টিকবে বলে মনে হচ্ছে না।
আপনার কাজ একটাই পেশেন্ট পার্টি কাউন্সেলিং। আপনি একটু ডেকে বলে রাখবেন পেশেন্ট এর কন্ডিশন।
-- বিপি, পালস, ইউরিন?
-- নো বিপি, নো পালস, নো আউটপুট আপু। অ্যা ভেরি ব্যাড নাইট ইস ওয়েটিং ফর ইউ। শুকনো একটা হাসি দিয়ে টুম্পা বেরিয়ে গেলো। ইভনিং শিফট করেছে সে আজ, ক্লান্তির ছাপ দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিকেল খুব খারাপ গেছে।
আমি হ্যান্ডওভার খাতাটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। ষোল জন পেশেন্ট এর লিস্টে আজ বেড- ২ শুধু লাইফ সাপোর্টে আছে।আমি বেড এর পাশে গেলাম। ফাইল টেনে পাতা উল্টাতেই নামের ঘরে চোখ আটকে গেলো। ডা: আক্তারুজ্জামান খান, বয়স ৪৮।
পালসে হাত রাখলাম, বরফের মত ঠান্ডা হাত। সিস্টার কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ফিরে আসলাম নিজের টেবিলে।
সিসিউতে আমার টেবিল এর পাশে একটা সেন্ট্রাল মনিটর আছে যাতে ষোল জন পেশেন্ট এর ইসিজি সহ অন্যান্য প্যারামিটারস দেখায়। মনিটর এর পেছনে সিসিউর মেইন এন্ট্রেন্স। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু পর পর চোক তুলে মনিটর দেখছি। রাত একটা কি দেড়টা হবে- হটাৎ দরজায় চোখ গেলো। একটা ১২/১৩ বছরের কিশোর দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ভয় ভয় চাহনি। ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্ততভাব। সিকিউরিটি দেখলাম তাকে ঢুকতে না দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
-- ম্যাডাম, দুই নম্বর রোগীর লোক আসছে।
-- রাত এখন কত লাল মিয়া? আপনি আমাকে এই কথা আবার বলতে এসেছেন! এখন কি ভিজিটিং আওয়ার?
-- ম্যাডাম বাচ্চাটা সন্ধ্যায় আইসছে। আমি তারে একবার দেখায়া দিছি। কিন্ত সে তখন থেইকা বাইরেই আছে। যাইতেছে না।
-- রোগী ওর কি হয়?
-- আব্বা লাগে। ম্যাডাম বাইরে একজন লোক আছে। আফনের লগে কতা কইতে চায়। আফনে অনুমতি দিলে পাডাইতাম।
--হুম, আসতে বলেন।
সিকিউরিটি দরজা খুলে দিতেই বাচ্চাটা প্রায় দৌঁড়ে দুই নম্বর বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখ বেড সাইড মনিটরের দিকে আর হাত পালসে দিয়ে প্রচন্ড উদ্বেগ নিয়ে সিস্টার কে জিজ্ঞেস করলো,
-- বিপি নাই, পালসও তো নাই সিস্টার, হাউ ইস হি নাউ?
আমি সাথের লোক টিকে ডেকে বসতে বললাম।
-- পেশেন্ট আপনার কে হন?
-- আমার স্যার। আমি উনার দেখা শোনা করি।
কিছুট অবাক হয়ে তাকালাম।
-- উনার ওয়াইফ কোথায়?
-- উনি নেই। ক্যান্সার ছিলো, ম্যাডাম ছিলেন শিশু বিশেষজ্ঞ। বাবুর বয়স যখন পাঁচ হটাৎ ক্যান্সার ধরা পড়ে। আপা স্যারকে কি বাঁচানোর কোনো উপায় নেই?
চুপ করে রইলাম। আমার চোখ আটকে আছে তখন ছেলেটার দিকে।
--আপা, বাবুর যে আর কেও থাকলো না। আপা, আমার স্যার এর নামে তার ভাইয়েরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। এই মুহূর্তে কোটি টাকা নিয়ে তারা প্রস্তুত। শুধু আপনারা একবার আশ্বাস দিন আপা। গলা ভিজে গেলো উনার।
-- আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করুন। তবে, উনার অবস্থা ভালো না।
এর মাঝেই বাচ্চাটা দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসলো।
-- ডক্টর বাবা কি সার্ভাইভ করবেন না? প্লিজ সে ইয়েস ডক্টর, আম্মু চলে গেছে। আব্বুকে আমার কাছে থাকতে দিন না প্লিজ!
কিছু বলতে পারছিলাম না, একটা কান্না দলা হয়ে আটকে যাচ্ছিল আমার গলায় যেনো।
-- আপু স্ট্রেইট লাইন ইসিজি। কি করব এখন?
ভোর সাড়ে চারটায় ডিক্লেয়ার দিলাম। ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম। অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম বাচ্চাটি তার বাবার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই মুখে। কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলাম। মাথা না তুলেই সে বলল,
-- থ্যাংকিউ ডক্টর। প্লিজ প্রে ফর হিম।
(২)
--আমার আব্বারে মেশিন থেইকা খুইলা দেন ম্যাডাম।
-- আর দুই এক দিন রাখলে ভালো হবে, আপনার বাবার অবস্থা এখন উন্নতির দিকে।
-- আমরা আর পারুম না ম্যাডাম, আমি ছোট খাটো ব্যাবসা করি, দোকান চালায় চকবাজারে। আমার পক্ষে আর সম্ভব না ম্যাডাম। আপনে মেশিন খুইল্লা দেন।
আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, যে আপনার বাবা এখন রেস্পন্স করছেন। উনার প্রেসার ভালো। পালসও ভালো। এরপর পেশেন্ট এর কাছে নিয়ে গেলাম।
জোরে ডাক দিলাম -বাবা, এই যে আমার দিকে তাকান দেখি।
উনি চোখ মেলে তাকালেন, আমার হাত ধরার চেষ্টাও করলেন। আমি উনার ছেলের হাত এগিয়ে দিলাম।
দেখলাম বৃদ্ধের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। চেয়ারে ফিরে আসলাম।
পেশেন্ট দুই দিন আগে হার্ট বন্ধ অবস্থায় আসে। ভাগ্য ভালো থাকায় লাইফ সাপোর্টে এসে সার্ভাইভ করে যায়। তার আউটকাম খুব ভালো হচ্ছিল। আমরা আশাবাদী ছিলাম যে আর দুই একদিন এর ভেতর মেশিন খোলা যাবে।
আমি ছেলেকে ডেকে আবার বুঝাতে চেষ্টা করলাম।
-- আপনারা উনাকে অল্প খরচের কোথাও নিয়ে যান। উনি বেঁচে যাবেন।
-- আপা, আমাদের যা ছিলো সব দিয়া এতদিন চালাইসি। এখন যতটুকু আছে তা দিলে আমার ছেলে মেয়েরা না খাইয়া মারা যাবে আপা। তাদের লেখা পড়া সব বন্ধ হইয়া যাবে। আপ্নে খুইলা দেন। আমি সই কইরা দিবো।
আমি কিছু বললাম না আর। হাসপাতাল আর আমার দায়বদ্ধতা থেকে আমাকে সে মুক্তি দিলো কাগজে সই করে। লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হলো।
দুটি ঘটনাই আমার জীবনে ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। একজন মানুষের অগাধ সম্পদ কিন্ত তার বাঁচার সময়টুকু ছিলো না! আর একজন সময় হাতে নিয়ে বসেছিলো কিন্ত বেঁচে থাকার মত অর্থ ছিলো না! নিয়তির কাছে দায়বদ্ধ এই দুজনের মিল ছিলো এক জায়গাতেই....মৃত্যুকে তারা জয় করতে পারেনি।
আর আমরা হেরে গিয়েছিলাম মধ্যবর্তী অধ্যায় হয়ে অসহায়ত্বের কাছে।